আফ্রিকার বুকে ভারত-চীন ছায়াযুদ্ধ: ঋণের ফাঁদ বনাম বিশ্বাসের কূটনীতি


আফ্রিকার বুকে নতুন ‘গ্রেট গেম’: চীনের ঋণের ফাঁদ বনাম ভারতের নীরব কৌশল

মেটা ডেসক্রিপশন: একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক দাবাখেলায় আফ্রিকা পরিণত হয়েছে প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে। একদিকে চীনের বিলিয়ন ডলারের ‘ঋণের ফাঁদ’ ও আগ্রাসী সামরিক বিস্তার, অন্যদিকে ভারতের আস্থা-নির্ভর ‘স্মার্ট পাওয়ার’ কৌশল। এই অদৃশ্য লড়াইয়ে কে এগিয়ে? আফ্রিকার ভবিষ্যৎ কোন পথে? একটি গভীর বিশ্লেষণ।



এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

বিশ্ব যখন অন্যান্য সংকটে নিমগ্ন, আফ্রিকার বিশাল ভূখণ্ডে নিঃশব্দে রচিত হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় কৌশলগত লড়াইয়ের চিত্রনাট্য। এই নতুন 'গ্রেট গেম'-এর প্রধান দুই খেলোয়াড় হলো চীন এবং ভারত। তাদের কর্মপন্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন, লক্ষ্যও আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন, কিন্তু চূড়ান্ত উদ্দেশ্য এক—আফ্রিকার ওপর প্রভাব বিস্তার এবং ভারত মহাসাগরে নিজেদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।

চীন যেখানে তার অর্থনৈতিক পেশিশক্তি বা ‘হার্ড পাওয়ার’ ব্যবহার করে আফ্রিকার দেশগুলোকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করছে, সেখানে ভারত হাঁটছে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। ভারতের কৌশল হলো ‘স্মার্ট পাওয়ার’—সামরিক সহযোগিতার আবরণে আস্থা তৈরি করা এবং আফ্রিকান দেশগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে তাদের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গড়ে তোলা। এই প্রবন্ধে আমরা দুটি দেশের বিপরীতমুখী কৌশলের ব্যবচ্ছেদ করব এবং বোঝার চেষ্টা করব, এই অদৃশ্য যুদ্ধে কার পাল্লা ভারী।

চীনের ‘হার্ড পাওয়ার’ মডেল: ঋণের জাল ও সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা

চীনের আফ্রিকা নীতির মূল ভিত্তি হলো তার উচ্চাভিলাষী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI)। এর আওতায় রাস্তা, বন্দর, রেললাইন এবং শিল্প পার্ক তৈরির জন্য চীন আফ্রিকার দেশগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর ও বিপজ্জনক ‘ঋণের কূটনীতি’ (Debt Trap Diplomacy)। যখন কোনো দেশ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন তার কৌশলগত সম্পদ, যেমন—বন্দর বা খনি, চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের ৯৯ বছরের লিজ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যা আফ্রিকার অনেক দেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা।

তবে চীনের লক্ষ্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামরিকও বটে। জিবুতিতে নির্মিত চীনের প্রথম বিদেশি নৌঘাঁটিটি এর জ্বলন্ত প্রমাণ। এই ঘাঁটি লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান জলপথ। এখান থেকে চীন কেবল জলদস্যু দমন বা শান্তিরক্ষা মিশনের কথাই বলে না, বরং এর আসল উদ্দেশ্য হলো ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর গতিবিধির ওপর নজরদারি করা এবং নিজের শক্তি প্রদর্শন করা। এই ঘাঁটি চীনের ‘স্ট্রিং অফ পার্লস’ বা মুক্তোর মালা কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার মাধ্যমে তারা ভারত মহাসাগরে ভারতকে ঘিরে ফেলতে চায়।

ভারতের ‘স্মার্ট পাওয়ার’ কৌশল: আস্থা নির্মাণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি

চীনের এই আগ্রাসী নীতির জবাবে ভারত এক দীর্ঘমেয়াদী এবং নীরব কৌশল গ্রহণ করেছে। চীনের ‘হার্ড পাওয়ার’-এর বিপরীতে ভারতের অস্ত্র হলো ‘স্মার্ট পাওয়ার’—যা ‘হার্ড’ এবং ‘সফট’ পাওয়ারের এক চতুর মিশ্রণ। গত এক দশকে ভারত আফ্রিকার সঙ্গে ১২.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের প্রতিরক্ষা ও উন্নয়ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু ভারতের মূল শক্তি তার অর্থ নয়, বরং তার প্রশিক্ষণ এবং অংশীদারিত্বের দর্শন।

ভারতের এই কৌশলের কয়েকটি দিক হলো:

  • সামরিক প্রশিক্ষণ: ইথিওপিয়া, বতসোয়ানা, ঘানা, কেনিয়া, নামিবিয়া-সহ প্রায় ২৫টিরও বেশি আফ্রিকান দেশের সেনাবাহিনীকে ভারতীয় প্রশিক্ষকরা কাউন্টার-টেরোরিজম, জঙ্গল ওয়ারফেয়ার, এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ভারত আফ্রিকান দেশগুলোর প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, যাতে তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই নিশ্চিত করতে পারে এবং কোনো বাহ্যিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল না হয়।

  • প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ: ভারত আফ্রিকান দেশগুলোকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী স্বল্পমূল্যে পেট্রোল বোট, ড্রোন, সামরিক যানবাহন এবং উপকূলীয় নজরদারি রেডার সিস্টেম সরবরাহ করছে। এটি কেবল প্রতিরক্ষা সম্পর্ককেই মজবুত করে না, বরং ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্যও একটি নতুন বাজার তৈরি করে।

  • মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ মোকাবিলা: ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলো নিয়মিতভাবে আফ্রিকার বিভিন্ন বন্দরে মানবিক সহায়তা (যেমন - 'অপারেশন ভ্যানিলা') এবং খাদ্যসামগ্রী নিয়ে পৌঁছায়। এটি ভারতের ‘সফট পাওয়ার’-এর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যা আফ্রিকান জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি আস্থা ও বন্ধুত্ব তৈরি করে।

ভারত মহাসাগরের দাবাখেলা: 


চীনের ‘মুক্তোর মালা’ ছেঁড়ার ভারতীয় প্রয়াস

ভারতের আফ্রিকা নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব খর্ব করা। আফ্রিকার পূর্ব উপকূল, যা চীনের BRI-এর সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার, সেখানেই ভারত তার নৌ-কূটনীতি জোরদার করেছে। মোজাম্বিক, তানজানিয়া, কেনিয়া, সেশেলস এবং মাদাগাস্কারের মতো দেশগুলোর সঙ্গে ভারত নিয়মিত যৌথ নৌ-মহড়া (যেমন - IMT-TRILAT) এবং তথ্য আদান-প্রদান করছে।

এর মূল উদ্দেশ্য হলো:

  1. সুরক্ষা বলয় তৈরি (Security Arc): উপকূলীয় রেডার নেটওয়ার্ক এবং যৌথ টহলের মাধ্যমে একটি অদৃশ্য সুরক্ষা বলয় তৈরি করা, যা চীনের যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনের গতিবিধির ওপর নজর রাখবে।

  2. বিকল্প সংযোগ স্থাপন: ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যা চীনের ‘মুক্তোর মালা’ কৌশলের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে।

বিশ্লেষণ: পেশিশক্তি বনাম অংশীদারিত্ব - কোন পথে আফ্রিকার ভবিষ্যৎ?

এই লড়াইয়ের একদিকে আছে চীনের দ্রুত পরিকাঠামো নির্মাণ এবং বিপুল বিনিয়োগের আকর্ষণ। অন্যদিকে আছে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী, আস্থা-নির্ভর এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির মডেল। চীনের মডেলটি দ্রুত ফল দেয়, কিন্তু তা সার্বভৌমত্ব ক্ষয়ের ঝুঁকি তৈরি করে। ভারতের মডেলটি ধীরগতির, কিন্তু তা দেশগুলোকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলে এবং একটি টেকসই অংশীদারিত্বের জন্ম দেয়।

এখন মূল প্রশ্ন হলো, আফ্রিকার দেশগুলো কোন পথ বেছে নেবে? তারা কি চীনের অর্থের বিনিময়ে দ্রুত উন্নয়ন চাইবে, নাকি ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবে?

এই অদৃশ্য যুদ্ধে এখনই কোনো চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা সম্ভব নয়। তবে এটা স্পষ্ট যে, ভারত নীরবে আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে একটি অপরিহার্য শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। চীনের অর্থনৈতিক দানবের সামনে ভারতের এই ‘স্মার্ট পাওয়ার’ কতটা কার্যকর হবে, তার ওপরই নির্ভর করছে ভারত মহাসাগর এবং আফ্রিকার ভবিষ্যৎ।



ভারত-আফ্রিকা সম্পর্ক, চীন-আফ্রিকা সম্পর্ক, আফ্রিকায় ছায়াযুদ্ধ, ঋণের কূটনীতি, স্ট্রিং অফ পার্লস, ভারতীয় নৌবাহিনী, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, স্মার্ট পাওয়ার, ভূ-রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, গ্রেট গেম, ভারত মহাসাগর।


#IndiaAfrica #ChinaInAfrica #Geopolitics #DebtTrap #IndianOceanPolitics #SmartPower #BRI #StrategicAffairs #NewGreatGame #ForeignPolicyAnalysis







Post a Comment

Previous Post Next Post