ডলারের পতন: ব্রিকসের নেতৃত্বে রাশিয়া, ভারত ও চীনের নতুন বিশ্বব্যবস্থা?

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, প্রতিটি সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে থাকে একটি ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ। আজ আমরা তেমনই এক বিদ্রোহের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। তবে এই বিদ্রোহের অস্ত্র তলোয়ার, বন্দুক বা কোনো অত্যাধুনিক অস্ত্র নয়; এই বিদ্রোহের মূল অস্ত্র— মুদ্রা, বাণিজ্য এবং ক্ষমতা। এই বিদ্রোহের নাম— BRICS

রাশিয়া, ভারত ও চীনের নতুন বিশ্বব্যবস্থা
ভলে যান আমেরিকা বা ইউরোপের বানানো পুরোনো সব নিয়ম। এক নতুন বিশ্বব্যবব্যবস্থা জন্ম নিচ্ছে আমাদের চোখের সামনে, যার নেতৃত্বে রয়েছে এমন সব দেশ, যারা আর পশ্চিমা বিশ্বের দাসত্ব মেনে নিতে রাজি নয়। আর এই বিপ্লবের অন্যতম প্রধান স্থপতি হলো রাশিয়া, ভারত, চীন ও সৌদি আরব—যারা এখন আর আমেরিকার বন্ধুত্বের ছায়ায় নয়, বরং চোখে চোখ রেখে নিজের শর্তে বিশ্ব রাজনীতিতে চালকের আসনে বসতে চায়।

আজ আমরা আপনাকে সেই গল্পের গভীরে নিয়ে যাব, যেখানে রাশিয়া, ভারত, চীন এবং সৌদি আরব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কীভাবে ডলারের তাসের ঘর ভেঙে ফেলার চূড়ান্ত খেলা শুরু করেছে। এই খেলা ইউরোপ ও আমেরিকার জন্য কতটা ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনছে এবং এই মহাসমরে বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে? শেষ পর্যন্ত পড়ুন, কারণ এই অর্থনৈতিক বিশ্বযুদ্ধ আপনার ভবিষ্যৎকেও বদলে দিতে চলেছে।


পেছনে ফিরে দেখা: যেভাবে শুরু হলো এই লড়াই

এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে কয়েক দশক ধরে। G-7 বা ধনী দেশগুলোর একটি ছোট দল পুরো বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিত। তারা ঠিক করত কে ঋণ পাবে, কার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো হবে, আর কার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। এই অর্থনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে ওঠে রাশিয়া এবং তাদের সাথে এসে দাঁড়ায় ভারত ও চীন।



২০০৯ সালে যখন ব্রিক (BRIC) তৈরি হয়, অনেকেই একে একটি কাগুজে বাঘ বলে হেসেছিল। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি, এটি ছিল শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্পের প্রথম কম্পন। এই জোটের মূল চালিকাশক্তি ছিল দুটি:

  • রাশিয়ার সামরিক এবং প্রাকৃতিক সম্পদের শক্তি।

  • ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং জনশক্তির দাপট।

ভারতের মাস্টারস্ট্রোক: ডলারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ

ভারত খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিল যে, ডলার-নির্ভর বিশ্বব্যবস্থায় আমেরিকার হাতে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র। এই ডলার ব্যবহার করেই আমেরিকা যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর যখন রাশিয়ার ওপর হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞা চাপানো হলো, তখন ভারত তার আসল রূপ দেখালো।

আমেরিকা ও ইউরোপের সমস্ত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে রেকর্ড পরিমাণে সস্তায় তেল কেনা শুরু করে। শুধু তাই নয়, ডলারকে পাশ কাটিয়ে রুপি-রুবল-এ বাণিজ্য করার পথ তৈরি করে, যা ছিল আমেরিকার মুখে সরাসরি এক চপেটাঘাত।

আসল খেলা শুরু: যখন মঞ্চে এলো সৌদি আরব

কিন্তু আসল খেলা জমে ওঠে তখন, যখন এই জোটে যোগ দেয় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইরানের মতো জ্বালানি শক্তিধর দেশগুলো। সৌদি আরব, যে দেশ গত ৫০ বছর ধরে আমেরিকার 'পেট্রোডলার' চুক্তি মেনে চলেছে, সেই দেশই আজ আমেরিকার বলয় ভেঙে ব্রিকসের মঞ্চে।

এর মানে কী? এর মানে হলো, যে তেলের ওপর ভিত্তি করে ডলারের রাজত্ব দাঁড়িয়ে ছিল, সেই তেলের নিয়ন্ত্রণ এখন ব্রিকসের হাতে! বিশ্বের ৪০ শতাংশের বেশি তেল এবং ৬০ শতাংশের বেশি খাদ্য উৎপাদনকারী দেশগুলো আজ এক শিবিরে।

ব্রিকসের ত্রিশক্তি: চীন, রাশিয়া ও ভারতের ভূমিকা

এই জোটের শক্তিকে একটি ত্রিভুজের সাথে তুলনা করা যায়:

  • অর্থনৈতিক ইঞ্জিন: চীন

  • সামরিক ও জ্বালানি শক্তি: রাশিয়া

  • কৌশলগত মস্তিষ্ক ও গণতান্ত্রিক মুখ: ভারত

ভারত এই জোটকে একটি ভারসাম্য দিচ্ছে, যা এটিকে কেবল একটি চীন-কেন্দ্রিক সংগঠনে পরিণত হতে বাধা দেয়। ভারত প্রমাণ করেছে, পশ্চিমা বিশ্বের বাইরেও একটি শক্তিশালী, আত্মনির্ভর এবং সমৃদ্ধ বিশ্বব্যবশ্যক তৈরি করা সম্ভব।

আমেরিকার দুঃস্বপ্ন: ডলারের পতন কতটা ভয়ঙ্কর?

এখন প্রশ্ন হলো, আমেরিকা এবং ইউরোপের জন্য বিপদটা ঠিক কতটা গভীর? এক কথায়— অকল্পনীয়

বিশ্বের প্রায় ৮৮% আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় ডলারে। যদি ব্রিকস দেশগুলো নিজেদের মধ্যে একটি নতুন মুদ্রা বা নিজেদের স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু করে, তাহলে বিশ্বজুড়ে ডলারের চাহিদা ধসে পড়বে।

আমেরিকার মাথায় এখন প্রায় ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি জাতীয় ঋণ। ডলারের পতন হলে এই ঋণের বোঝা পাহাড়সমান হয়ে যাবে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমেরিকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ভেঙে পড়বে, যা দেশটিকে চরম সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে। ইউরোপের অবস্থাও হবে সঙ্গীন, কারণ তাদের অর্থনীতিও আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এমনকি এই আঘাত হানতে পারে ন্যাটো জোটের মধ্যেও এবং সেখানেও বাজতে পারে ভাঙনের সুর।

চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা: ভারত-চীন বিবাদ কি বাধা হবে?

অবশ্যই, ব্রিকসের পথ এতটা সহজ ছিল না। ভারত ও চীনের মধ্যেকার সীমান্ত বিরোধ এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু উভয় দেশই বুঝতে পারছে যে, পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার এই ঐতিহাসিক সুযোগের কাছে তাদের आपसी বিরোধ অনেকটাই গৌণ।

এক পরিবারের দুই ভাই যখন বিবাদ ভুলে এক হয়, তখন তাদের শক্তি কতটা মজবুত হয় তা সহজেই অনুমেয়। আজ দুই প্রতিবেশী বুঝতে পেরেছে যে, তাদের आपसी কোন্দল তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্রের সুযোগ করে দেয়। তাই আজ তারা আবারো সব বিবাদ ভুলে এক টেবিলে।

এই মহাসমরে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

এই বিশাল ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? বাংলাদেশ এখনও ব্রিকসের সদস্য না হলেও, ২০২১ সালে তারা ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (NDB) সদস্য হয়েছে। এর মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্থা বিশ্বব্যাংক বা IMF-এর বাইরেও অর্থায়নের একটি নতুন দরজা খুলেছে। ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পে NDB-এর প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণ এরই জ্বলন্ত প্রমাণ।

এটি বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল সুযোগ। ব্রিকস-চালিত একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাংলাদেশকে আরও ভালো শর্তে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কভাবে পথ চলতে হবে। একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রপ্তানি বাণিজ্য ধরে রাখা, অন্যদিকে ব্রিকসের উদীয়মান শক্তির সাথে তাল মেলানো—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখাই হবে বাংলাদেশের কূটনীতির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

উপসংহার: নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূর্যোদয়

বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্য আজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একদিকে ডলারের অস্তগামী সাম্রাজ্য, অন্যদিকে ব্রিকসের নেতৃত্বে এক নতুন সূর্যোদয়। ভারত, রাশিয়া, চীন এবং সৌদির এই জোট কি পারবে একটি নতুন এবং আরও ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে?

এই অর্থনৈতিক বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল যা-ই হোক, এটা স্পষ্ট যে পুরোনো দিন শেষ। বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার দাবা খেলার ছকটি নতুন করে সাজানো হয়ে গেছে।


প্রশ্ন (Call to Action):

এই বিষয়ে আপনার কী মত? ভারত কি সঠিক পথেই এগোচ্ছে? ডলারের ভবিষ্যৎ এবং ব্রিকসের উত্থান নিয়ে আপনার ভাবনা কী? কমেন্ট করে আমাদের জানান।

আর্টিকেলটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং এই ধরনের গভীর বিশ্লেষণ নিয়মিত পেতে আমাদের সাইট ভিজিট করুন।

Post a Comment

Previous Post Next Post