জিন্নাহর পরিকল্পিত মৃত্যু: পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে কেন অবহেলায় মরতে হলো?

জিন্নাহর পরিকল্পিত মৃত্যু

 

জিন্নাহর মৃত্যু: রাষ্ট্রের অবহেলা নাকি সুপরিকল্পিত হত্যা?

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ক্রনিকল অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড’-এর কথা কি মনে আছে? একটি পরিকল্পিত মৃত্যু, যার কথা সবাই আগে থেকেই জানত, কিন্তু কেউ предотвратить এগিয়ে আসেনি। যেন সেই মৃত্যু নিয়তি ছিল না, ছিল এক নীরব ষড়যন্ত্রের ফসল। আজকের কাহিনীও তেমনই এক মৃত্যুর—যার পরিণতি সবাই আঁচ করতে পারলেও কেউ তাকে রক্ষা করেনি।

তিনি আর কেউ নন, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। যে মানুষটি একটি রাষ্ট্র তৈরি করলেন, সেই রাষ্ট্রেরই নির্মম অবহেলায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। ‘তর্ক বিতর্ক’-এর প্রথম পর্বে আমরা ফিরে যাব ১৯৪৮ সালের সেই অন্ধকার দিনে এবং উন্মোচন করব রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার করুণ পরিণতির পেছনের রহস্য।



🕯️ রাষ্ট্রের পিতা, রাষ্ট্রের অবহেলিত লাশ

দিনটি ছিল ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দীর্ঘদিন ধরে টিউবারকিউলোসিস বা টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কোয়েটা থেকে করাচিতে নিয়ে আসা হয়। বিমানটি যখন করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে, তখন ‘কায়েদ-ই-আজম’ হিসেবে পরিচিত মানুষটি শ্বাসকষ্ট নিয়ে নেমে আসেন।

কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে স্বাগত জানাতে সেখানে কোনো সুসজ্জিত হাসপাতাল বা সরকারি তৎপরতা ছিল না। প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও কোনো অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছায়নি। যে অ্যাম্বুলেন্সটি পরে এসেছিল, সেটিও মাঝ রাস্তায় নষ্ট হয়ে যায়। পাকিস্তানের স্থপতি অসহায়ভাবে একটি ভাঙা গাড়ির মধ্যে শুয়ে ছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্ট্যানলি ওলপার্ট তাঁর বই "Jinnah of Pakistan" (১৯৮৪)-এ লিখেছেন: “করাচির উত্তপ্ত রাস্তায় একটি ভাঙা অ্যাম্বুলেন্সে জিন্নাহ কার্যত অযত্নে মারা যান, তাঁর তৈরি রাষ্ট্রের দ্বারাই অবহেলিত হয়ে।” এই মৃত্যু কেবল দুঃখজনকই নয়, এটি ছিল বেইমানির এক চূড়ান্ত নিদর্শন।

❓ব্যর্থতা নাকি পরিকল্পিত অবজ্ঞা?

অনেকেই যুক্তি দেন যে, নবগঠিত পাকিস্তানের তখন তেমন কোনো অবকাঠামো ছিল না, তাই এই ঘটনা একটি দুর্ঘটনা মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—তিনি তো তখনো পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, অর্থাৎ সর্বোচ্চ শাসক ছিলেন! রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকা একজন ব্যক্তির জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা কি এতটাই কঠিন ছিল?

এই চরম অবহেলা কি শুধুই প্রশাসনিক অযোগ্যতা? নাকি এর পেছনে ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্র? জিন্নাহর আদর্শ কি পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল?

🧩 আদর্শের সংঘাত: ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একটি আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৪৭ সালের ১১ই আগস্ট গণপরিষদে দেওয়া তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন: “You are free... religion is not the business of the state.” অর্থাৎ, “আপনারা স্বাধীন... ধর্ম রাষ্ট্রের কোনো বিষয় নয়।” তিনি এমন একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলেন যেখানে ধর্ম হবে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়, আর রাষ্ট্র থাকবে নিরপেক্ষ।

কিন্তু জিন্নাহর এই আদর্শ পাকিস্তানের প্রভাবশালী সামরিক ও ধর্মীয় অভিজাতদের চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। তারা একটি কট্টর, ধর্মভিত্তিক ও সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান গড়তে চেয়েছিল। ফলে, জিন্নাহ তাদের কাছে এক অস্বস্তিকর আদর্শিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন।

প্রকাশ্যে তাঁকে সরানো সম্ভব ছিল না, কারণ তিনি ছিলেন ‘কায়েদ-ই-আজম’ বা জাতির পিতা। তাই কি ধীরে ধীরে রাষ্ট্র তাঁকে একা করে দিয়েছিল? তাঁর অসুস্থতার কথা গোপন রাখা হয়েছিল এবং তাঁর চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত, একটি ভাঙাচোরা অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।

লেখক ইয়াসের লতিফ হামদানি তাঁর বই "Jinnah: A Life" (২০২০)-এ বলেছেন: “পাকিস্তান যে পথে এগোচ্ছিল, তার জন্য জিন্নাহ ছিলেন বড্ড বেশি আধুনিক।” পাকিস্তান রাষ্ট্র যেন তার প্রতিষ্ঠাতার আদর্শকেই ভয় পেতে শুরু করেছিল।

শেষ কথা

জিন্নাহকে হয়তো সরাসরি হত্যা করা হয়নি, কিন্তু তাঁকে বাঁচানোরও কোনো চেষ্টা করা হয়নি। আর এটাই ছিল সম্ভবত সবচেয়ে নির্মম ও রাজনৈতিক একটি মৃত্যু। এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, রাষ্ট্র কখনো কখনো তার নিজের স্রষ্টাকেও ভয় পায়, যদি সেই স্রষ্টার আদর্শ রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের পথের সঙ্গে না মেলে। তখন তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলাই হয় রাষ্ট্র “রক্ষার” একমাত্র উপায়।



Post a Comment

Previous Post Next Post