ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিরক্ষা কৌশল যে কতটা দূরদর্শী, তার এক উজ্জ্বল প্রমাণ মিলল সাম্প্রতিক মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা (DIA)-এর 'ওয়ার্ল্ড থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট ২০২৫' রিপোর্টে। এই গভীর বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে তুলেছে, কীভাবে ভারত বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক মঞ্চে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করছে।
![]() |
মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টে যা ফাঁস হলো! |
ড্রাগনকে সামলানো: ভারতের প্রাথমিক লক্ষ্য চীন!
রিপোর্টটি পরিষ্কারভাবে বলছে, ভারত চীনকে তার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে, যা পাকিস্তানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি ভারতের বাস্তববাদী এবং আগাম-চিন্তাভাবনার নিরাপত্তা নীতির পরিচায়ক। চলমান সীমান্ত সংঘাত এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মুখে, এই স্পষ্ট মূল্যায়ন ভারতকে তার প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি ও কৌশল নির্ধারণে সঠিক পথে চালিত করছে। ভারত শুধু চীনের প্রভাব মোকাবিলাই করছে না; বরং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং ইন্দো-প্যাসিফিকে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে বৈশ্বিক নেতৃত্বে নিজের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে চাইছে। এই সক্রিয় ভূমিকা প্রমাণ করে যে ভারত কেবল আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে নেই, বরং আক্রমণাত্মক কূটনীতি এবং শক্তিশালী সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও অর্থনৈতিক উত্থান: রাশিয়া ও বিশ্ব মঞ্চে ভারত
ডিআইএ (DIA) রিপোর্টে ভারতের রাশিয়া নীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয়েছে। ভারত ও রাশিয়ার ঐতিহাসিক ও গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিশ্বজুড়ে সুবিদিত, যা দশকের পর দশক ধরে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়েছে। এই রিপোর্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই সম্পর্ক বজায় রাখার ভারতের সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ।
বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির আসনে বসতে চলা ভারত, বিশ্ব মঞ্চে নিজের প্রভাব বাড়াচ্ছে। এই অর্থনৈতিক উত্থানের পাশাপাশি, ভারত তার ঐতিহ্যবাহী মিত্র রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখেই অন্যান্য দেশের সাথেও সুসম্পর্ক স্থাপন করছে। রাশিয়া-চীনের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও, ভারত রাশিয়াকে একটি ভারসাম্যকারী শক্তি হিসেবে দেখে, যা ভারতকে একই সময়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে এবং দীর্ঘদিনের বন্ধু রাশিয়ার সাথে সংযোগ বজায় রাখতে সাহায্য করছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে রুশ সামরিক সরঞ্জাম কেনার পরিমাণ কিছুটা কমেছে, পুরনো রুশ সরঞ্জামের খুচরা যন্ত্রাংশের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা উভয় দেশের মধ্যে একটি কার্যকরী সম্পর্ক বজায় রাখতে উৎসাহিত করছে – যা ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের এক অনন্য উদাহরণ। ভারত তার অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও সুসংহত করছে, যেখানে পুরোনো বন্ধুত্বও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত: আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্থপতি
সর্বশেষে, রিপোর্টটি চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে গভীর সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরেছে। পাকিস্তান চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সমর্থনের প্রধান গ্রহীতা এবং তাদের সেনাবাহিনী প্রতি বছর চীনের পিএলএ-এর সাথে একাধিক যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করে। নভেম্বর ২০২৪-এ একটি নতুন বিমান মহড়াও সম্পন্ন হয়েছে। এই তথ্যগুলো ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হলেও, চীনকে তার প্রাথমিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে ভারত প্রমাণ করছে যে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা পুরোপুরি প্রস্তুত। ভারত শুধু নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে না, বরং একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
পরিশেষে, 'ওয়ার্ল্ড থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট ২০২৫' রিপোর্টটি ভারতের প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র নীতির কার্যকর প্রয়োগের এক স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। এটি প্রমাণ করে যে ভারত কেবল তার নিজের স্বার্থ রক্ষাই করছে না, বরং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল অংশীদার হিসেবেও কাজ করছে।